অনলাইন সীমান্তবাণী ডেস্ক : করোনা অতিমারি এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্বের কারণে গত কয়েকবছর বিশ্ব অর্থনীতি টালমাটাল অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে। বৈশ্বিক মূল্যস্ফীতি বিশেষ করে খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়ায় দেশের অভ্যন্তরে সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতির চাপ সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে সরকার আগামী ১ জুন, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করতে যাচ্ছে। দেশের শীর্ষস্থানীয় অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. আতিউর রহমান তার এক বাজেট ভাবনা তুলে ধরেছেন। সেটি হুবহু তুলে ধরা হলো।
এ কথা সবারই জানা যে পুরো বিশ্ব অর্থনীতিই একটি টালমাটাল অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথমে করোনার ধাক্কা। আর তা কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই শুরু হলো রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ।
ইতোমধ্যেই বৈশ্বিক সাপ্লাই চেইনগুলো এর কারণে ব্যাপক মাত্রায় বাধাগ্রস্ত হয়েছে। বিনিয়োগকারীরা খুব সাবধানে পা ফেলছেন। ফলে, উন্নত বিশ্বের দেশগুলোতেও মানুষের আয় কমছে। আর মূল্যস্ফীতির চাপ তো রয়েছেই। আর ওই সব দেশে মানুষের অর্থনৈতিক চাপে পড়া মানে পণ্য ও সেবার চাহিদা কমে আসা। তার ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলোর রপ্তানি আয়ও পড়ে যাচ্ছে হুমকির মুখে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও আমরা এমনটি ঘটতে দেখছি। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের মতো প্রায় সবদেশের জন্যই মুদ্রানীতি ও জাতীয় বাজেটের মধ্যে সুসমন্বয়ের মাধ্যমে একটি ছকবদ্ধ পরিকল্পনা নিয়ে এগানোর বিকল্প নেই। এ প্রসঙ্গে আইএমএফের ফিসক্যাল অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক ভিটোর গ্যাসপার যথার্থ সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করে বলেছেন, ‘উচ্চমূল্যস্ফীতি, ব্যাপক ঋণের বোঝা, বর্ধিষ্ণু সুদের হার এবং ক্রমবর্ধমান অস্থিতিশীলতার প্রেক্ষাপটে মুদ্রানীতি ও জাতীয় বাজেটের মধ্যে সমন্বয় নিশ্চিতকরণ সর্বোচ্চ গুরুত্বের দাবিদার। এজন্য অধিকাংশ দেশেই জাতীয় বাজেটকে সংকোচনমুখী রাখা বাঞ্ছনীয়।’ পাশাপাশি আর্থিকখাতের স্থিতিশীলতার বিষয়টিও সমান গুরুত্ব দিয়ে দেখতে হবে। ইউরোপীয় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান ক্রিস্টিন লাগার্দে সম্প্রতি দুটো দিকের ওপরই গুরুত্ব দেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
অনেকে বাংলাদেশের চলমান সঙ্কট মোকাবিলায় মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না- এমন ধারণা দিচ্ছেন।
তবে সত্যি হলো মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে একটি দরকারি ধাপ হলো মুদ্রানীতির মাধ্যমে নীতি সুদের হার বাড়িয়ে বাজারে টাকার সরবরাহ নিশ্চিত করা। সুদের হার না বাড়িয়ে মূল্যস্ফিতি কমানোর নজির নেই। তবে এর সঙ্গে কিছু বাজেটারি পদক্ষেপও দরকার হবে। কেননা সাপ্লাই সাইড সক্রিয় করেও মূল্যস্ফীতি খানিকটা নিশ্চয় কমানো সম্ভব। মূল্যস্ফীতির পেছনে সরবরাহ ঘাটতির বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়। খাদ্য মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে কৃষিতে সরকারি বিনিয়োগ এবং কম বা বিনামূল্যে নিম্ন আয়ের মানুষকে খাদ্য সরবরাহের মাধ্যমে সামাজিক সংরক্ষণে বাজেট বরাদ্দ বাড়ানোর প্রয়োজন রয়েছে।
ফলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করে সঙ্কট উত্তরণের জন্য মুদ্রানীতি ও বাজেটের মধ্যে সুসমন্বয় যে একান্ত জরুরি- এ কথা মানতেই হবে।
আশার কথা এই যে- বাংলাদেশে আমরা এরই মধ্যে আপৎকালীন মুদ্রানীতি বাস্তবায়ন হতে দেখছি। বার্ষিক মুদ্রানীতির অনাকাক্সিক্ষত ব্যবস্থা থেকে ষাণমাসিক ব্যবস্থায় ফিরে আসায় বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতিসহ সংশ্লিষ্ট সূচকগুলোর গতিপ্রকৃতি বোঝা আগের চেয়ে অর্থবহ হবে। বৈশ্বিক বিনিময় হারের পরিবর্তনের ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মার্কিন ডলারের বিপরীতে টাকারও ব্যাপক অবমূল্যায়ন হয়েছে। পাশাপাশি রিজার্ভ থেকে ডলার বাজারে বিক্রি করে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার চেষ্টাও হয়েছে। কিছুটা ধীরে হলেও মুদ্রা বিনিময়ের ক্ষেত্রে বাজারভিত্তিক একক বিনিময় হারের দিকে এগোচ্ছে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক। আমদানির কারণেই যেহেতু মূল্যস্ফীতির চাপ বাড়ছে তাই বিলাসী ও অপ্রয়োজনীয় আমদানি নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। তবে এখনো কিন্তু সবচেয়ে বড় যে ভাবনার বিষয়, অর্থাৎ মূল্যস্ফীতির লাগাম টেনে ধরা তার কাক্সিক্ষত সুফল ওই অর্থে দেখা যাচ্ছে না। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, মূল্যস্ফীতির হার (পয়েন্ট টু পয়েন্ট হিসেবে) ফেব্রুয়ারি ২০২৩-এ ৮ দশমিক ৭৮ শতাংশ। ফলে বলা যায়, মুদ্রানীতিতে যতই গণমুখী চিন্তার প্রতিফলন ঘটানো হোক না কেন সামষ্টিক অর্থনৈতিক বাস্তবতার কারণে এ হার বিশেষ করে নিম্ন আয়ের নাগরিকদের জন্য চাপ হয়েই থাকবে। আর এ চাপ থেকে তাদের সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে জাতীয় বাজেটে। রমজান উপলক্ষে পণ্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে রাখার ক্ষেত্রে বাজার ব্যবস্থাপনা এবং তার সঙ্গে সমন্বয় করে শুল্ক ও সড়ক ব্যবস্থাপনায় বেশ কিছু ভালো উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এসব ব্যবস্থা রোজার পরও যেন অব্যাহত থাকে সে তাগিদ বাজেট প্রণেতাদেরও দেয়া উচিত। কেননা বাজেট শুধু অঙ্কের মারপ্যাঁচ নয়। তার একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রভাবও জনমনে পড়ে।
ভুর্তকি কমিয়ে আনা এবং নিত্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির প্রেক্ষাপটে জাতীয় বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তাখাতে বাড়তি বরাদ্দের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষকে সুরক্ষা দেওয়ার ওপর জোর দিতেই হবে। মনে রাখতে হবে সর্বশেষ খানাভিত্তিক আয়-ব্যয়ের জরিপ মতে আমাদের দারিদ্র্য হার ১৮ শতাংশের কিছু বেশি এবং অতিদারিদ্র্য ৫ শতাংশের আশপাশে নেমে এসেছে। আর দারিদ্র্য ও অতিদারিদ্র্য হার যত কমে আসে তা আরও কমিয়ে আনাটি ততোই বেশি চ্যালেঞ্জিং হয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে ‘পোভার্টি পকেটস’গুলোকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে সেগুলোর জন্য উপযোগী বিশেষ সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি ও উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নেওয়া একটি চমৎকার সমাধান হতে পারে। বাংলাদেশের চরাঞ্চল এমন ‘পোভার্টি পকেটস’-এর অন্যতম। আমাদের জাতীয় বাজেটে চলতি বছরে সামাজিক সুরক্ষা ১৭ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হলেও চরের জন্য সুনির্দিষ্ট বরাদ্দ কিন্তু খুবই নগণ্য (১ শতাংশেরও কম)। আসছে বছরে তাই চরাঞ্চলসহ অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার মানুষদের জন্য সুনির্দিষ্ট সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে বরাদ্দ দেওয়া দরকার। একইসঙ্গে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ এলাকার জন্য সমন্বিত অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রকল্প নেওয়া যেতে পারে। পল্লী উন্নয়ন বিভাগ এই প্রকল্প নিতে পারে। এতে একইসঙ্গে সোলার সেচ, বহুমুখী কৃষি, খুদে ও মাঝারি উদ্যোক্তা এবং জনশক্তি উন্নয়নমূলক প্রশিক্ষণ, সংযোগধর্মী অবকাঠামো, ই-মার্কেটিংসহ বাজার ও সংরক্ষণ ব্যবস্থার উন্নয়নের উদ্যোগ নেওয়া যেতে পারে। সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তিখাত ও বেসরকারিখাতের অংশীজনকে এই প্রকল্পের সঙ্গে সংযুক্ত করলে জন-অংশগ্রহণমূলক উন্নয়ন গতি পাবে। এবারের বাজেটে এমন ধারার উন্নয়নের তাগিদ দেওয়ার নিশ্চয় সুযোগ রয়েছে।
স্বাস্থ্য ও শিক্ষাকে আমরা জানি বাজেটের সামাজিক খাত হিসাবে। সঙ্কোচনমুখী বাজেট তো প্রণয়ন করতেই হবে। তবে এ সংকোচনের চাপ থেকে খাত দুটিকে যত সুরক্ষা দেওয়া যায় ততই মঙ্গল। এজন্য স্বাস্থ্যখাতের উদাহরণ টানা যায়। বাজেটে এখাতের জন্য সাধারণত ৫-৬ শতাংশ বরাদ্দ থাকে। এটি বাড়িয়ে যদি ৭-৮ শতাংশ করা যায় এবং ওই বাড়তি বরাদ্দ যদি বিনামূল্যে ওষুধ সরবরাহ এবং গ্রামাঞ্চলের স্বাস্থ্য কেন্দ্রে শূন্যপদে জনবল নিয়োগ দিয়ে তাদের পারিশ্রমিক বাবদ ব্যয় করা যায়, তাতে গ্রামাঞ্চলে প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা প্রার্থীদের অর্থনৈতিক চাপ অনেকটাই কমবে। বর্তমানে তারা মোট স্বাস্থ্য ব্যয়ের ৬৮ শতাংশ বহন করছে। যেভাবে বললাম সেভাবে বরাদ্দ দেওয়া গেলে এ অনুপাত কমে ৫০ শতাংশে নেমে আসতে পারে। শিক্ষার ক্ষেত্রেও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রেক্ষাপটকে বিবেচনায় রেখে বরাদ্দের ধারাবাহিকতা বজায় রাখা গেলে মানুষের কর্মসংস্থান ও আয় দুই-ই বাড়বে।
রাজস্ব প্রসঙ্গে যে কথাটি না বললেই নয় তা হলো আমাদের জিডিপি প্রবৃদ্ধি যে হারে হচ্ছে সে তুলনায় রাজস্ব আহরণ বাড়ছে না। জিডিপির তুলনায় আমাদের রাজস্ব ১০ শতাংশেরও কম। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে কখনই এই অনুপাত ১০ শতাংশের বেশি হতে পারেনি। কিন্তু সমতুল্য অন্য দেশগুলোতে এই অনুপাত আরও বেশি হওয়ায় আমি মনে করি বাংলাদেশে জিডিপির অন্তত ১৫ শতাংশের সমপরিমাণ কর আহরণ খুবই সম্ভব। ইদানীং আইএমএফসহ অন্য আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগীরাও সরকারের আয় বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথাটি জোর দিয়ে বলতে শুরু করেছে। জিডিপির অন্তত আধা শতাংশ বাড়তি রাজস্ব আদায়ের তাগিদ দিচ্ছে তারা। তাই আসছে বছরের বাজেটে রাজস্ব আয় বৃদ্ধিকে আগের তুলনায় বাড়তি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবেন নীতি নির্ধারকরা। সন্দেহ নেই, এটি একটি চ্যালেঞ্জিং লক্ষ্য। তবে যথাযথ পরিকল্পনা নিয়ে এগোলে এ লক্ষ্য অর্জন খুবই সম্ভব।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বড় বড় চ্যালেঞ্জের মুখেও বৃহত্তর জনস্বার্থের প্রতি সংবেদনশীলতার জায়গা থেকে আমাদের নীতি নির্ধারকরা বাজেট প্রণয়ন করেছেন এবং তার বাস্তবায়নে যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন। তাই আসছে অর্থবছরেও তারা এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে সক্ষম হবেন বলেই মনে করি।
আশা করা যায়, বিগত তিনটি অর্থবছরে সংকটকালীন বাজেট প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের যে অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তার ভিত্তিতে আসছে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট প্রণয়নে বিদ্যমান বাস্তবতার প্রতি আরও বেশি সংবেদনশীলতা দেখাতে সক্ষম হবেন আমাদের বাজেট প্রণেতারা। একইসঙ্গে জনগণকেও বুঝতে হবে একটি ঝুঁকিপূর্ণ বিশ্ব অর্থনৈতিক পরিবেশে এই বাজেটটি প্রণয়ন করতে হচ্ছে। তাই নুন আনতে পানতা ফুরানোর আশঙ্কা থাকতেই পারে। সবাইকে এই বাস্তবতা মেনেই আগামী বাজেটকে বিশ্লেষণ করার মানসিকতা দেখাতে হবে।
Leave a Reply